নাম |
কাজী নজরুল ইসলাম
(খ্যাতিমান লেখক)
|
লিঙ্গ: |
পুরুষ
|
পেশা: |
|
ওয়েবসাইট: |
|
মাতৃভূমী: |
কলকাতা |
বর্তমান নিবাস:
স্থায়ী নিবাস: কলকাতা
সংক্ষিপ্ত জীবনি:
কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯-২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬- ১২ ভাদ্র ১৩৮৩) বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং অবিভক্ত বাংলার সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। যার গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। কবি নজরুল ইসলাম সব ধর্মের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাঁর একটি কবিতার বিখ্যাত একটি লাইন ছিল - 'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।' তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম হয়। বাবা ছিলেন কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহিদা খাতুন। বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাযারের খাদেম। দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করা নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মভিত্তিক। তাঁর ভবঘুরে বাল্যকাল আর তাঁর স্কুল শিক্ষা নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে।
তিনি স্থানীয় মক্তবে (মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) কুরআন, ইসলাম ধর্ম , দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে যখন তার বাবা মারা যান তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে পারেননি। জীবিকার তাগিদে বাল্যকালে খানসামা ও চায়ের দোকানে রুটি বানানোর কাজ করেছেন।
অল্প বয়সে স্থানীয় মসজিদে তিনি মুয়াজ্জিনের কাজ করেছিলেন। কৈশোরে ভ্রাম্যমাণ নাটক দলের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে সাহিত্য, কবিতা ও নাটকের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেননা। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমান নাট্যদল) দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফারসি ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন।
১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ সালের শেষভাগ থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন। দাসত্বের শৃঙ্খলে বদ্ধ জাতিকে শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত হবার ডাক দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, 'বল বীর বল উন্নত মম শির...যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না -বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত!'
তরুণ বয়সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন নজরুল । করাচিতে গিয়েছিলেন ১৯১৭ সালে। স্বাধীনতা সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষা থেকেই তিনি যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। ১৯২০ সালে তিনি যখন কলকাতা ফিরে গেলেন, তখন কিন্তু তাঁর মূল স্বপ্নই ছিল ভারতকে স্বাধীন করা। তিনি বহু লেখায় বলেছেন সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে হবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সৈনিকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেনাবাহিনীর কাজ শেষ করে কলকাতায় ফেরার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন 'বিদ্রোহী' এবং 'ভাঙার গানের' মতো কবিতা এবং ধূমকেতুর মতো সাময়িকী। জাতীয়তবাদী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার জন্য বহুবার কারাবন্দী হয়েছিলেন নজরুল ইসলাম। জেলে বন্দী অবস্থায় লিখেছিলেন 'রাজবন্দীর জবানবন্দী'। তাঁর এইসব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল প্রকট। সাংবাদিকতার মাধ্যমে এবং পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যকর্মে নজরুল শোষণের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
নজরুল ছিলেন সব ধর্মীয় চেতনার ঊর্ধ্বে। অন্তরে তিনি না ছিলেন হিন্দু না ছিলেন মুসলিম। তাঁর একটি কথাতেই এটা ছিল পরিষ্কার- 'জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জুয়া'। তিনি সবার ঊর্ধ্বে ছিলেন মানবতার কবি। গোটা ভারতবর্ষেই তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। তার বন্ধুবান্ধবরা নজরুল ইসলামকে মনের মন্দিরে বসিয়ে রেখেছিল। তারা মনে করতেন নজরুল তাদের জন্য একজন পথের দিশারী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলামকে বর্ণনা করেছিলেন 'ছন্দ সরস্বতীর বরপুত্র' হিসাবে। অনেক বিশ্লেষক বলেন তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতা তাঁকে অমর করে রেখেছে। নজরুলের প্রতিভার যে দিকটা ছিল অনন্য সেটা হল তাঁর বিদ্রোহী চেতনার বহি:প্রকাশ- সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি সব কিছুর বিরুদ্ধেই বিদ্রোহে তিনি সোচ্চার হয়েছেন তাঁর সাহিত্যকর্ম ও সঙ্গীতে।
তিনি শুধু কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন গীতিকার, সুরকার, গল্পকার, সাংবাদিক, উপন্যাসিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার ও একাধারে রাজনৈতিক কর্মীও। কখনও তিনি গান গেয়েছেন, কখনও পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, কখনও রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করেছেন। নজরুল সম্ভবত ওই সময়ের প্রথম বাঙালি, যিনি বাংলার নবজাগরণের যে ঐতিহ্য সেটা ধারণ করেছিলেন এবং তার মধ্যে দিয়ে তিনি বাঙালিকে একটা শক্ত, সবল নতুন চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
নজরুল উঠে এসেছিলেন সমাজের অতি পেছিয়ে থাকা শ্রেণি থেকে। শুধু দারিদ্রই নয়, শিক্ষার অভাবের মধ্যে দিয়ে তিনি বড় হয়েছিলেন- প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থেকে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তাঁর জীবন কেটেছিল। প্রতিকূলতায় ভরা ওই জীবনের মধ্যে দিয়েই তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ ছিলেন নজরুল। যে পথ দিয়ে তিনি গেছেন, যে প্রকৃতিতে তিনি লালিত হয়েছেন, যে পারিপার্শ্বিকতায় তিনি বেড়ে উঠেছেন, সেগুলো তাঁর অজান্তেই তাঁর ওপরে ছাপ ফেলে গেছে। তারই বহি:প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর গানে ও কবিতায়। নজরুলের গান ও কবিতা একেবারে নিচ থেকে ওঠা মানুষের গান, তাদের কথা। যারা দলিত, যারা অত্যাচারিত, যাদের ভাষা ছিল না, নজরুলের কলমে তারা ভাষা খুঁজে পেল। 'কথিত আছে কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটে হ্যারিসন রোডের মুখে একটা রিক্সাওয়ালাকে তিনি একদিন রাত বারোটায় গিয়ে বলেছিলেন – “এ্যাই তুই তো অনেককেই নিয়ে যাস্ রিক্সায় টেনে। ঠিক আছে আজ তুই রিক্সায় বোস্ আর আমি তোকে টেনে নিয়ে যাই।'' তাঁর সাহিত্যকর্মেও প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের প্রতি তাঁর অসীম ভালবাসা আর মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
নজরুল তাঁর ধূমকেতু পত্রিকায় কংগ্রেস স্বাধীনতা দাবি করার আগেই ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেছিলেন। সেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথাও তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলেন। বাঙালি ঐতিহ্যের প্রধান যে দুটি ধারা হিন্দু এবং মুসলিম, তার সমান্তরাল উপস্থিতি এবং মিশ্রণ ঘটেছিল নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মে, সঙ্গীত সৃষ্টিতে এবং জীবনাচরণে, যা আর কোন কবি সাহিত্যিকের মধ্যে দেখা যায়নি।
নজরুল যখন যুদ্ধ ফেরত কলকাতা শহরে এলেন, তখন তার ওপর সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলেছিল ভারতীয় উপমহাদেশে সেসময় আসা নতুন এক সাম্যবাদী চিন্তাচেতনার জোয়ার। সেই চিন্তাধারার মধ্যে ছিল নিচের তলার মানুষকে আপনজন ভাবতে শেখা। সাহিত্য যে শুধু এলিট বা শিক্ষিতদের জন্যই নয়, সেটা তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন। সেই যুগে একটা ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছিল- যেটা হল দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সমাজ বিপ্লবকে মেলানো। স্বদেশী আন্দোলনে যারা যুক্ত ছিলেন তারা সমাজ বিপ্লবের কথা ভাবতেন না। কিন্তু এই বিপ্লব ছিল নজরুলের রক্তে। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা নজরুল চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মনে করতেন এর পথে প্রধান বাধা সাম্প্রদায়িক সংঘাত। সেইজন্য তিনি দুর্গম গিরি কান্তার মরু গানে বলেছিলেন - হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন? কাণ্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার। উপমহাদেশের রাজনৈতিক নেতারা, প্রধান যে সমস্যা- সাম্প্রদায়িক সমস্যা সেইদিকে মনোনিবেশ করেননি বলেই ভারত টুকরো হয়েছে।
যে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন যুগের জন্ম দিয়েছিলেন বলে বলা হয়, সেই রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই নজরুল বাংলা সাহিত্যে আরেকটা যুগের সূচনা করেছিলেন। যারা সবকিছু ভেঙে নতুন করে গড়তে চাইছে তাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল নজরুল ইসলামের জ্বালাময়ী কবিতা - বিদ্রোহী। সবকিছু ভেঙে নতুন করে গড়ার চেতনা প্রকাশ পেয়েছিল এই রচনায়। সেই কবিতা রাতারাতি তাঁকে একেবারে কেন্দ্রে বসিয়ে দিয়েছিল। তার পরবর্তী আট দশ বছর ধরে তিনি যে সাম্যের গান গাইলেন, নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বললেন, কৃষক মজুরের দুঃখের কথা বললেন, কৃষক শ্রমিক পার্টির হয়ে কাজ করলেন- এ সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে তাঁর যে মন প্রকাশ পেল তা ছিল একেবারে আলাদা। এর মধ্যে কোন আভিজাত্য নেই। একেবারে নিচ থেকে ওঠা মানুষের গান। তাদের কথা। যারা দলিত, যারা অত্যাচারিত যাদের ভাষা ছিল না, নজরুলের কলমে তারা ভাষা খুঁজে পেল।
নজরুল বাংলা ভাষায় একটা নতুন প্রাণ নতুন তারুণ্য নিয়ে এসেছিলেন। সৃষ্টি করেছিলেন একটা নিজস্ব ভাষার, যে ভাষার মধ্যে তিনি দেশজ বাংলার সঙ্গে সফলভাবে ঘটিয়েছিলেন বহু আরবি ও ফারসি শব্দের সংমিশ্রণ। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা করেছিলেন এবং অধিকাংশ গানে নিজেই সুরারোপ করেছিলেন যেগুলো এখন "নজরুল গীতি" নামে বিশেষ জনপ্রিয়।
এক হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে তাঁর মত অসাম্প্রদায়িক কবি আর দেখা যায়নি। তাঁর পরিচয় ছিল মানুষ হিসাবে। তাঁর লেখার মধ্যে কখনই তিনি হিন্দু না মুসলমান তা প্রবল হয়ে দেখা দেয়নি। বাংলা ভাষায় তিনিই একমাত্র কবি যিনি সমানভাবে হিন্দু ও মুসলমানদের বিশ্বাসের কথা, তাদের জীবনাচরণের পদ্ধতির কথা, তাঁর কাব্য ও সাহিত্যের মধ্যে তুলে ধরেছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার দিনে, যুদ্ধের দিনে, দ্বিজাতি তত্ত্বের দিনে তিনি যেভাবে বাংলার জয়গান করে গেছেন এর কোন তুলনা বাংলা সাহিত্যে বিরল।
প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে তার প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল। তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৪২ সালে মধ্যবয়সে এক দুরারোগ্য রোগে কবি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। অসুস্থ হবার আগে ৪০এর দশকে তিনি যখন জাতীয়তাবাদী মুসলিম পত্রিকা দৈনিক নবযুগের প্রধান সম্পাদক ছিলেন তখন একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন 'বাঙালির বাংলা'। সেখানে তিনি লিখেছিলেন— “বাংলার সব শিশুকে, বালককে এই শিক্ষা দাও- এই মন্ত্র দাও যে বাংলা হচ্ছে বাঙালির, এখান থেকে রামাদের আর গামাদের অর্থাৎ মাড়োয়াড়ি আর পাঞ্জাবিদের বহিষ্কার করতে হবে এবং বলো -জয় বাংলার জয়।”
নজরুল অসুস্থ হবারপর তাঁর পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তারা নিভৃতে ছিলেন। ১৯৫২ সালে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর ১৯৫৩ সালের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। মে ১০ তারিখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন ছাড়েন। লন্ডন পৌঁছানোর পর বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। অবশেষে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও আরো অবনতি হতে শুরু করলে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তনে কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করে। ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ (১২ ভাদ্র ১৩৮৩) ঢাকার পিজি হাসপাতালে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পার্শ্বে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে।
কবি তার একটি কবিতায় বলেছিলেন—
“মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই, যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।” এই কবিতায় তার অন্তিম ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। তার এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তার সমাধি রচিত হয়।