সাজিদদের পূর্বপুরুষেরা এইখানে বসবাস করছে বেশ কয়েক দশক ধরে। গ্রামটিকে ফাঁকা করে আস্তে আস্তে সবাই চলে গেছে নাগরপুর শহরে। আগেও খুব বেশি বসতি ছিলো না এখানে। এখন বলতে গেলে কোনও বসতিই নেই। যে কয়েকটা বাড়ি আছে তাও ঝোপ-বাগান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। সাজিদরা খুব কম আসে এখানে। যতোটা আবাদি জমি আছে তার প্রায় সবটাই বর্গা চাষের জন্য কাছাকাছি বসবাসকারী চাষীদের কাছে দেয়া হয়েছে। এখানে যে পরিমাণ জমি আছে তার বেশিরভাগের মালিকানা সাজিদের বাবার। অন্য মালিকদের অনেকেই সাজিদের বাবার কাছে তাঁদের জমি ক্রমে ক্রমে বিক্রি করে দিয়েছেন।
শীতকালে ঝোপ-বাগানের চেহারা দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। একেবারে রুগ্ন, শুষ্ক। পাতাঝরা গাছগুলোকে দেখে কঙ্কাল মনে হয়। বসন্তের অপেক্ষায় থাকে কঙ্কালগুলো। বসন্ত এলেই সেগুলোতে প্রাণ জেগে ওঠে। সবুজে সবুজে শরীরী রূপ পায় যেনো। হরেক রকমের ফলের গাছ আছে এই বাগানে। তার মধ্যে সবেধন নীলমণি যেনো একমাত্র জামগাছটি। সবুজ পত্তরের সমারোহে হলুদাভ সাদা ফুলের সমাবেশ বসেছে। সেই ফুলগুলো পরিণত হলো ফলে। সবুজ কচি জামগুলো ফেঁপে ফুলে গেলো। পাকা জামের গাঢ় নীল রঙে জামগাছ জুড়ে সবুজ-নীলের ছড়াছড়ি।
জামগাছের খুশিতে আত্মহারা হবার কথা। তা কিন্তু হলো না। জামগাছের খুশিতে বাঁধ সেধেছে তিলপোকা, পিঁপড়া, পাখি, মৌমাছি আর কাঠবিড়ালি। জামগাছটির গোড়ালিজুড়ে অসংখ্য তিলপোকা, শাখাপ্রশাখায় পিঁপড়ার আনাগোনা, পাকা জামের থোকায় থোকায় শত শত মৌমাছি আস্তানা আর নিত্যকার ভোঁ ভোঁ শব্দ, কাঠবিড়ালির শক্ত ঠোঁটের ঠকঠক আওয়াজ জামগাছটির প্রতিদিনের অস্বস্তির কারণ। তার উপর জামগাছের ডালে ডালে দুলেদুলে ডিগবাজি খায় কাঠবিড়ালিটা, সম্মুখের পা বাড়িয়ে থোকা থেকে পাকা জাম ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায় আর মনের সুখে লেজ নাড়িয়ে এদিক ওদিক চায়। জামগাছের মন খুব খারাপ। পোকা-পশু-পাখির উৎপাতে সে খুব বিরক্ত।
আজ প্রতিবাদের ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে। অনেকদিন রাগ-ক্ষোভ সংবরণ করা হয়েছে, আজ আর নয়। মাথাটা উঁচু করে চারদিক ভালো করে দেখে নিলো জামগাছটা। ডালপালাগুলোকে যতোটা পারলো সোজা করে নিলো। একটা ঝাঁকুনি দিলো পুরো শরীরে। গলা বাড়িয়ে বিকট এক শব্দ করলো। আশেপাশের কারও বুঝতে অসুবিধা হলো না যে আজ জামগাছটা তাদের সবাইকে কিছু বলতে চাইছে। নিয়ন্ত্রিত স্বরেই প্রশ্ন করে বসলো জামগাছটা।
'আমার অতিথিগণ! ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলাগণ! আমাকে বলুন তো, আর কতোদিন আপনারা আমার বাড়িতে থাকবেন?'
'বলেন কী! এটা আমাদেরও বাড়ি। আমরা সব সময় আপনার পাশে এই বাড়িতেই থাকবো,' মৌমাছিরা সমস্বরে উত্তর দিলো।
'না, না! তোমরা সব সময় ভোঁ ভোঁ করো। আমাকে খুবই বিরক্ত করো। তোমাদের ভোঁ ভোঁ শব্দে আমার আরাম হারাম হয়ে গেছে। শুধু তোমরা না। তিলপোকারা আমার গোড়ালির মাটিগুলোকে খুঁড়ে খুঁড়ে বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। আর কাঠবিড়ালি! তার কথা আর কী বলবো! তিনি তো সারাক্ষণ লাফালাফি, ছোটাছুটি করছেন। পিঁপড়াগুলোর কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। আমার শরীরের উপর দিয়ে সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করছে। এটা আমার বাড়ি, অথচ আমিই টিকতে পারছি না!'
ক্ষুব্ধ জামগাছের এহেন অভিযোগ শুনে তিলপোকা ও পিঁপড়াদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেলো। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এগিয়ে এসে জামগাছের অভিযোগের উপযুক্ত জবাব দিতে শুরু করলো।
'শুনুন, জামগাছ মশাই, হ্যাঁ, এটা আপনারই বাড়ি। আমাদের থাকতে দিচ্ছেন বলে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আপনি যে অভিযোগ করেছেন তা পুরোপুরি ঠিক নয়। আমড়া হয়তো আপনাকে বিরক্ত করি, কিন্তু আপনি কি জানেন আমরা আপনার কতোটা উপকার করি?'
'উপকার! হা হা হা হা হা......' অট্টহাসি পেলো জামগাছটার। পেটে খিল ধরা সেই হাসিতে চারপাশের বাতাসে প্রচণ্ড দোল তৈরি হলো। পাকা পাকা জামগুলো ঝরঝর করে নিচের ঝোপগুলোর উপর পড়ে গেলো। জামগাছের রাগ কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। তবুও সেই রাগকে অনেক কষ্টে সংবরণ করলো সে। কাউকেই সে রাগ বুঝতে দিলো না। আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো,
'আচ্ছা, বলো তো শুনি, তোমরা কীভাবে আমার উপকার করো?'
'দেখুন, জামগাছ মশাই, আমরা দিনে রাতে আপনার শিকড়ের আশপাশের মাটিগুলো খুঁড়ে খুঁড়ে নরম করে দিচ্ছি। দিচ্ছি না?'
'তো?'
'তাই তো আপনি আপনার শিকড়গুলোকে অনায়াসে মাটির গভীরে নিয়ে যেতে পারছেন। মাটির গভীরে শিকড় না নিয়ে যেতে পারলে আপনি কীভাবে পানি, খনিজ লবণ শোষণ করতে পারতেন? কোথা থেকে পুষ্টি পেতেন?'
তিলপোকা আর পিঁপড়াদের কথাগুলো জামগাছের সম্ভিতকে যখন জাগ্রত করছে বলে মনে হলো ঠিক তখনই উপর থেকে মৌমাছির দলও যোগ দিলো জামগাছের অভিযোগ খণ্ডনে। তারাও জামগাছকে কিছু কথা শুনিয়ে দেবার জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে লাগলো।
'শোনো হে জামগাছ ভাই, তোমার ফুল থেকে মধু তোলে কে? বলো, কে তোলে মধু? এই আমরা তুলি। আমরা যদি মধু না তুলতাম তাহলে কীভাবে তুমি পরাগায়ন করতে? কীভাবে ফল তৈরি করতে? পারতে বীজ তৈরি করতে? তোমার বংশবৃদ্ধি পেতো?'
মৌমাছিদের প্রশ্নের উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো জামগাছটা ঠিক সেই সময় তার ডালে ডালে বসা পাখিগুলোও সমস্বরে তার অভিযোগের উত্তর দিতে শুরু করলো।
'জামগাছ ভাই, আমরা তোমার অভিযোগগুলো শুনেছি। আমাদের বিরুদ্ধে তোমার অনেক অভিযোগ। আমাদেরও কিন্তু আত্মসম্মান আছে, তাই উত্তর না করে না থাকতে পারছি না। আমাদের কথাবার্তাকে তোমার কাছে কিচিরমিচির আওয়াজ মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা যে শব্দগুলো করি সেগুলো কান পেতে শুনেছো কোনও দিন? শুনে দেখো, তোমার ভালো লাগবে। তোমার মনকে প্রফুল্লিত করবে। আর আমরাও তোমার অনেক উপকার করি।'
'তোমরাও আমার উপকার করো! কীভাবে? কী কী উপকার করো? বলো তো শুনি।'
'আমরা তোমার পাকা ফলগুলো খাই।'
'সেই তো! আমার পাকা পাকা ফলগুলো খাচ্ছো। খাচ্ছো মানে কী? একেবারে সাবাড় করে দিচ্ছো। আর বলছো কি না আমার উপকার করছো! হা হা হা হা হা ...।'
'আরে ভাই, পুরো কথাটা শুনবে তো!'
'আচ্ছা, আচ্ছা, বলো, শুনছি।'
'এই যে, আমরা তোমার পাকা ফলগুলো খাই। এরপর বীচিগুলো এখানে সেখানে ফেলে দিচ্ছি। সেই বীচিগুলো থেকে নতুন গাছের জন্ম হচ্ছে। তোমার বংশবৃদ্ধি পাচ্ছে। তাহলে আমরা কি তোমার উপকার করছি না?'
জামগাছ কোনও উত্তর দিলো না। শুধু মাথাটা নাড়লো।
জামগাছকে চুপ থাকতে দেখে সবাই একসাথে আওয়াজ করে উঠলো, 'দেখো, জামগাছ ভাই, তুমি আমাদের থাকবার জায়গা দিয়েছো, খাবার ব্যবস্থাও করেছো। আমাদের উপকার করছো। আমরাও কিন্তু তোমার উপকার বৈ অপকার করছি না। চারদিকে ভালো করে তাকাও, জামগাছ ভাই। দেখো, আমাদের দ্বারা তোমার কতো উপকার হচ্ছে।'
জামগাছ মন দিয়ে ভাবতে শুরু করলো। সত্যিই তো, যাদের সে এতোদিন ঝামেলার মনে করেছে, বিরক্তির উৎস মনে করেছে তারাই কি না তার কতো উপকার করছে! যাদের সে এতোদিন ধরে সকল বিপত্তির, নিরানন্দের উৎস মনে করে এসেছে তারাই হচ্ছে তার প্রকৃত বন্ধু!
জামগাছ বুঝতে পারলো তার বাড়ির এই অতিথিদের সবাই তার উপকারী বন্ধু। মাথা দুলিয়ে সে সবাইকে ধন্যবাদ জানালো। সবাইকে বললো তাকে ছেঁড়ে কখনো চলে না যেতে।
'সত্যি আমার অতিথিবৃন্দ, আজ তোমরা আমার চোখ খুলে দিয়েছো। আমি এতোদিন বুঝতে চেষ্টাও করি নি যে তোমরা আমার অনেক উপকার করছো। আজ থেকে থেকে আমরা সবাই সবার ......' জামগাছ তার কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না। অন্য সবাই একসাথে তার অসম্পূর্ণ কথা সম্পূর্ণ করে দিলো।
'বন্ধু, বন্ধু, বন্ধু।'
চারদিকে হাসি আর আনন্দের ঢেউ ছড়িয়ে পড়লো।