অঙ্কন: মোনায়েম খান নিজাম
নিজের ঘরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো বুবুন। বারো বছরের বুবুনকে আগেও রাগ করতে দেখেছেন মা বনি বিশ্বাস। কিন্তু আজকের রাগী বুবুনের সাথে আগের কোনো বুবুনের তুলনাই চলে না। বনি বিশ্বাস ছেলের রাগের কারণ তৎক্ষণাৎ খুঁজে পেলেন না। ছেলের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
'কিরে বুবুন, বাইরে গেলি, ফিরেও এলি। আবার রাগ করে ঘরে ঢুকলি। আমাকে কিছু বললিও না। ঘরে ঢুকেই ধুম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলি। কিছু হয়েছে, বাবা?'
'না, কিছু হয় নি।'
'তাহলে রাগ রাগ মুখ করে বাসায় ঢুকলি কেনো? রুমে ঢুকেই দরজা দিলি কেনো? কিছু একটা তো হয়েছে। বন্ধুদের সাথে ঝগড়া করেছিস নাকি?'
'হাহ, আমার কতো বন্ধু আছে এইখানে! সবাইতো মহাখালী আর বাড্ডার দিকে থাকে। বনানীতে আমার কোনও বন্ধু আছে নাকি?'
'আরে বাবা! তাহলে এতো রাগ কীসের? কী হয়েছে? দরজা খোল। আমাকে বল কী হয়েছে।'
'ওহ মা! তুমি যাওতো। আমাকে একা থাকতে দাও। আমার মুড অফ।'
'সেটাই তো জানতে চাচ্ছি। কী কারণে তোর মুড অফ হলো? মুডটা কি অন করা যায় না?'
বুবুন আর উত্তর দিলো না। বনি বিশ্বাস বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে তাঁর ছেলের। বুবুনের বাবা কিছুক্ষণ আগে বাইরে থেকে এসে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছেন। ঘুমিয়ে পড়েন নি এখনো। স্ত্রীর আওয়াজ শুনে জিজ্ঞেস করলেন,
'কী হয়েছে? চিৎকার করছো কেনো, বনি?'
'চিৎকার করলাম কোথায়? তোমার ছেলে ঘরের দরজা দিয়েছে। বের হচ্ছে না।'
'ওহ, সাইকেল চালিয়ে খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে হয়তো। এখন আরাম করছে। সময় হলে বের হবে। ওর ঘরে তো আর এটাচড বাথরুম নেই। বাথরুম লাগলেই বেরিয়ে আসবে।'
এরকম কথা শুনলে বুবুনের খুব হাসি পায়। আজ সে হাসলো না। স্কুলে তার সহপাঠিরা যখন 'বাথরুম যাবো, বাথরুম যাবো' বলে তখন সবার আগে বুবুনই হাসে। ওর হাসি দেখে বাকি সবাই হাসে। সেই হাসিতে ওদের ক্লাসরুমের বেঞ্চগুলো হাসে, হোয়াইটবোর্ডটা হাসে, ফ্যানগুলো হাসে, লাইটগুলোও হাসে! বাংলার মিস অনেক রাগী স্বভাবের। তিনিও হাসেন!
বনি বিশ্বাস স্বামীর কথার উপর ভরসা রাখলেন। টিভি রুমে গিয়ে টি-টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে হিন্দি সিরিয়াল দেখা শুরু করলেন। একই সিরিয়াল, একই পর্ব তাঁর দুই-তিনবার দেখা চাই। 'এতো বেশি বেশি সিরিয়াল দেখেন কেনো?' এরকম প্রশ্নের সোজা উত্তর দেন তিনি, 'মাস গেলে তিনশত টাকা ডিশের বিল দিয়ে হয়, বেশি বেশি সিরিয়াল দেখে ডিশওয়ালাদের বারোটা বাজিয়ে দিতে হবে না?' প্রশ্নকর্তা বুঝতে পারেন না এতে ডিশওয়ালার বারোটা বাজে কীভাবে!
বুবুনের বাবা ঘুমের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন। ঘুমালে নাক ডাকা চাই তাঁর। ছেলেকে ডাকার সুযোগই হলো না। বনি বিশ্বাস মজে আছেন হিন্দি সিরিয়ালে। বুবুনের কথা কেউ আর ভাবছেনই না! দরজার বাইরে মা আর দাঁড়িয়ে নেই। ছেলেকেও আদর করে বাইরে বের হতে বলছেন না। বুবুনের রাগ বেড়ে গেছে বহুগুন। বিড়বিড় করে কী যেনো বলছে সে। টিভির আওয়াজে বুবুনের সেই বিড়বিড় শব্দ ড্রয়িং রুম পর্যন্ত পৌঁছালো না। ঘরের এক কোণে চুপটি মেরে বসে পড়লো সে। ড্রয়িং বক্সের পেন্সিলগুলো, পেস্টিলগুলো, ইরেজার- সবকিছু ছুঁড়ে মেরেছে ঘরের চতুর্দিকে। গত জন্মদিনে ছোটমামা যে টয়গুলো দিয়েছিলো সেগুলোও ফেলে দিলো বিছানার উপর। একবার মুখ ফিরিয়ে দেখলো টয়গুলো ভেঙে গেলো কি না। নাহ, ভাঙে নি! দু'ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ছাড়লো সে।
দেখতে দেখতে অনেকখানি সময় কেটে গেছে। বনি বিশ্বাস রান্না ঘরে ঢুকলেন। বিকেলের নাস্তার যোগাড় করতে হবে। রান্না ঘর থেকে ডাইনিং রুমে ঢুকছেন, আবার ডাইনিং রুম থেকে রান্না ঘরে ঢুকছেন। বুবুনের কোনও সাড়াশব্দ নেই। বনি বিশ্বাস সেটা অনেকক্ষণ খেয়াল করেন নি। অবশেষে ছেলের কথা মনে পড়লো তাঁর। এবার চুলোর উপর কিছু একটা চাপিয়ে দিয়ে বুবুনের রুমের দিকে গেলেন। দরজায় নক করলেন। কোনও সাড়া নেই। অগত্যা ডাকাডাকি শুরু করলেন।
'বুবুন, এই বুবুন। ঘুমিয়েছিস নাকি? ওঠ বাবা, আমার লক্ষ্মী বাবা, আমার হীরা বাবা, আমার মানিক বাবা, আমার নাক গুলগুল-চোখ গুলগুল বাবা, নাস্তা করবি না। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। দরজা খোল। বের হ, বাবা।বাথরুম যাবি না? এতোক্ষণেও তোর বাথরুম লাগে নি! বাথরুমে যা। হাতমুখ ধুয়ে ড্রয়িং রুমে আয়। বিকেলের নাস্তাটা সবাই মিলে টিভি দেখতে দেখতে সেরে ফেলেন বলেই হয়তো ছেলেকে ড্রয়িং রুমে ডাকলেন। আবার রান্না ঘরে ঢুকলেন তিনি। কয়েক মিনিট পার হয়ে গেলো। বুবুন দরজা খুললো না।
বনি বিশ্বাসের চিন্তা হচ্ছে। ঘুমন্ত স্বামীকে ঘুম থেকে উঠানোর চেষ্টা করলেন। পারলেন না। অফিসে নাইট ডিউটি ছিলো, তাই হয়তো তাঁর ঘুমটা আজ অনেক গভীর। স্বামীকে ঘুম থেকে তুলতে পারলেন না বনি বিশ্বাস। সদর দরজার চাবিটা নিয়ে বাসার নিচে চলে গেলেন। একটু পর ফিরেও এলেন। বনি বিশ্বাসের মুখে হাসির রেখা দেখা যাচ্ছে।
স্বামীকে ঘুম থেকে তুলে কিছু একটা বললেন। ফিসফিস সে আওয়াজ ঘরের বাইরে থেকে শোনা গেলো না। ছেলের ঘরের দিকে উঁকি মারলেন আর হাসলেন। সন্ধ্যা হতে চললো। নিচ থেকে সিকিউরিটি গার্ড ইন্টারকমে ফোন করেছে। বনি বিশ্বাস ফোনটা তুলে তার সাথে কথা বললেন। সে কথাও বুঝতে পারা গেলো না। শুধু 'আচ্ছা, আচ্ছা' শব্দটিই শোনা গেলো।
বুবুনের বাবা বাথরুম থেকে বের হয়ে হাত-মুখ মুছতে মুছতে ড্রয়িং রুমে এসে বসলেন।
'বুবুনকে ডাকো। সন্ধ্যা হয়ে এলো, ও এখনো ঘর থেকে বের হলো না! এতোক্ষণ ঘুমাচ্ছে! ডাকো ওকে।'
বনি বিশ্বাস ছেলের ঘরের দিকে গেলেন। দরজায় নক করলেন। ডাকাডাকি শুরু করলেন। বুবুন বেরিয়ে এলো। এতোক্ষণ স্বেচ্ছায় বন্দি থেকে হাঁফিয়ে উঠেছে সে। ঘুমায় নি। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলো। মাঝেমাঝে কেঁদেছে। দুচোখের দিকে তাকালেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়।
বনি বিশ্বাসের চোখে সেটা খুব সহজেই ধরা পড়লো। ছেলেকে কাছে টেনে নিলেন।
'কি রে, কেঁদেছিস কেনো? এতো রাগইবা করেছিলি কেনো?'
মাকে জড়িয়ে ধরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিলো বুবুন। বুবুন যখন কাঁদে তখন ওর বয়স বারো মনে হয় না, মনে হয় ছয়-সাত বছরের শিশু। বুবুনের বাবাও ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।
'কি রে, কাঁদছিস কেনো? কী হয়েছে? ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন বাবা গোপাল বিশ্বাস।
'আজ আমার বাইসাইকেলটা ড্রেনে পড়ে গিয়েছিলো, বাবা। সা মনের চাকাটা বাঁকা হয়ে গেছে। আমার সাইকেলটা শেষ! আমি এখন থেকে কী চালাবো?'
কথা শেষ হতে না হতেই আবার কান্না শুরু করলো সে। বনি বিশ্বাসের হাসি পেলো। এরকম সময়ে মায়ের হাসি পছন্দ হলো না বুবুনের।
'মা, আমি কাঁদছি আর তুমি হাসছো!'
ছেলের হাত ধরে বাইরে যাওয়া শুরু করলেন বনি বিশ্বাস। বুবুন যেতে চাইলো না।
'আমি নিচে যাবো না। ঐ বাইসাইকেল আমি চোখে দেখতে পারবো না, মা। আমার বাইসাইকেল পুরাই গেছে! শেষ হয়ে গেছে আমার বাইসাইকেলটা।'
'আরে বাবা, আয় তো। আয় আমার সাথে। একটা মিরাকেল ঘটে গেছে। চল, দেখবি।'
'মিরাকল!' বুবুনের কৌতুহল হলো, তবে মুখ থেকে বিষাদের ছাপ দূর হলো না।
গোপাল বিশ্বাসও ওদের পিছন পিছন নিচে চলে গেলেন। বুবুনের বাইসাইকেলটা একটা সবুজ কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। বুবুন সেটার দিকে ইশারা করে মাকে বোঝাতে চাইলো যে এই হচ্ছে তার ভাঙা বাইসাইকেল।
'কি রে বুবুন। তোর বাইসাইকেল কোথায়?'
মায়ের প্রশ্নের উত্তরে কিছু না বলে আঙ্গুল তুলে সবুজ কাপড়ে মোড়ানো বাইসাইকেলটার দিকে আরেকবার ইশারা করলো সে। বনি বিশ্বাস বুবুনের হাত ধরে সেই কাপড় মোড়ানো সাইকলটার দিকে এগিয়ে গেলেন। ছেলেকে বললেন কাপড়টা সরাতে।
'না, মা। আমি পারবো না। এই বাইসাইকেল দেখলে আমার আরও কান্না পাবে। প্লিজ, তুমি এটাকে এভাবেই রেখে দাও।'
'আরে বাবা! আমি বলছি, তুই কাপড়টা সরিয়ে দেখ।'
বুবুন এবার দুইহাত দিয়ে সবুজ কাপড়টা সরিয়ে দিলো। দুচোখ বড় বড় করে সে বাইসাইকেলটির দিকে তাকিয়ে আছে। একদম নির্বাক। অবাক দৃষ্টিতে শুধু বাইসাইকেলটিকেই দেখছে।
'মা, এটা আমার বাইসাইকেল?'
'হ্যাঁ, এটাই তোর বাইসাইকেল।'
'এ তো দেখি একদম ঠিক। কে ঠিক করলো? কখন ঠিক করলো?'
'সে যেই ঠিক করুক, আর যখনই ঠিক করুক। তুই এখন খুশিতো?'
খুশিতে হাসি থামে না বুবুনের। বাইসাইকেলটা নিয়ে তখনই বাসার নিচেই রাউন্ড দেয়া শুরু করলো সে।
'আরে বাবা, এখনই চালাতে হবে বাইসাইকেলটা? কাল চালাস। এখন উপরে চল।'
ছেলের খুশি দেখে গোপাল বিশ্বাস বুঝতে পারলেন বুবুন আরও কিছুক্ষণ সাইকেলটা চালাতে চায়। ছেলেকে বললেন একটু পর উপরে আসতে। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি উপরে চলে গেলেন। বুবুন মনের সুখে তার প্রিয় বাইসাইকেলটা নিয়ে খেলতে থাকলো।